হিউম্যান হ্যাকিংঃ কী ও কীভাবে?

হিউম্যান হ্যাকিংঃ কী ও কীভাবে

ধরুন, আপনার ব্রেইন কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অথবা আপনার চিন্তা ভাবনা, আইডিয়া কিংবা মনের গোপন কথা আপনার অজান্তেই আরেকজন হ্যাক করছে। কিন্তু আপনি তার কিছুই জানতে পারছেন না। ব্যাপারটা তাহলে কেমন হবে? মনে হতে পারে এটা একটা গল্প কিংবা ‘ইন্সেপশন’ সিনেমার কাহিনী। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান সেই কথাই বলছে। আর খুব দ্রুত সেটা ঘটতেও যাচ্ছে। আর এসব সম্ভব হবে নিউরোসায়েন্সের কল্যাণে।

নিউরো টেকনোলজি যেভাবে এগুচ্ছে তাতে কয়েক দশকের মধ্যেই কল্পনা সত্যি সত্যিই বাস্তবতায় রূপ নেবে। একুশ শতকের নিউরোসায়েন্টিস্টরা বলছেন যে, আগামী একশ বছরের মধ্যেই নিউরোসায়েন্সের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে যাচ্ছে।

তখন মানুষ পরিশ্রম ছাড়াই টেকনোলজির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। তখন হাত-পা বা শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে কোনো কাজ করতে হবে না। শুধুমাত্র মস্তিষ্ক দ্বারা চিন্তা করলেই নিউরো টেকনোলজির কল্যাণে সেটা হয়ে যাবে।

ব্যাপারটা একটু উদ্ভট মনে হচ্ছে তাই না? আচ্ছা তাহলে একটু সহজ করে বলি, ধরুন আপনি ফেসবুক বা টুইটারে কিংবা ইন্সটাগ্রামে একটা পোস্ট করতে চাচ্ছেন। এই জন্য আপনাকে প্রথমে আইডিটাতে লগ-ইন করতে হবে, তারপর কষ্ট করে কিবোর্ডে টাইপ করে লিখতে হবে। তারপর পোস্টটা করতে হবে। তাই না? কিন্তু নিউরো টেকের কল্যাণে আপানকে এতকিছু করতে হবে না। আপনি তখন শুধুমাত্র ব্রেইনকে কমান্ড করবেন যে, আপনি একটা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে চান আর সাথে স্ট্যাটাসে কি লিখতে চান। আপনার মস্তিষ্ক তখন নিউরো টেকনোলজিতে ফেসবুকের সাথে কানেক্ট হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্টটা করে ফেলবে। বেশ মজাদার তাই না?

তারপর মনে করুন, আপনি এখন নিজে পছন্দের কোন রেসিপিতে রান্না করে খেতে চাইছেন। আপনাকে কষ্ট করে রান্না ঘরে গিয়ে রান্নাও করতে হবে না। আপনি তখন শুধু মাত্র আপনার ইচ্ছেটাকে মস্তিককে জানাবেন, ব্যাস তাহলেই হবে! মস্তিষ্ক তখন আপনার ব্রেইন থেকে রেসিপির ফর্মুলাটা আপনার রোবট বাবুর্চির ব্রেইনে পাঠিয়ে দিবে। আর সেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা রোবট কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই খাবারটা বানিয়ে আপনার সামনে হাজির হবে। এবার আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন!

নিউরোসায়েন্স আসলে কী, এটা নিয়ে অনেকের ধারনাই এখনো অস্পষ্ট। আমি তাহলে খুব ছোটো করে এক কথায় বলি। কেমন?

মস্তিষ্কের বিদ্যা, ক্ষমতা ও রহস্য সবকিছু মিলেই নিউরোসায়েন্স!

নিউরো টেকনোলজির মাধ্যমে মানুষ এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে। অনেকটা ইএসপি ক্ষমতা, টেলিপ্যাথির মতোই। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে টেকনোলজি! মানুষ চাইলেই তার ব্রেইনের মেমোরি পাওয়ার বাড়াতে কমাতে পারবে। চাইলেই ফেসবুকের নিউজফিডের মত স্ক্রল করে অতীতের স্মৃতি দেখা যাবে, চোখের সামনে। তখন মানুষ ভবিষ্যতে যেতে সক্ষম হবে কিনা জানি না কিন্তু নিউরো টেকনোলজি দ্বারা সহজেই অতীতের তথ্য এক্সেস করতে পারবে যেটাকে বলে, পার্ফেক্ট রিকল! এটাও এক ধরনের টাইম ট্র্যাভেলের মতোই।

শুধু তাই না আপনি চাইলে তখন আপনার পুরনো স্মৃতি এডিট কিংবা ডিলিটও করতে পারবেন এবং সকল মরণব্যাধি রোগের চিকিৎসাও সফল ভাবে করা সম্ভব হবে। তাছাড়া বিষন্নতা, স্মৃতিভ্রংশ বা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের মতো বিভিন্ন মানসিক ব্যাধি নিউরো টেকনোলজির মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব হবে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, কারো যদি মন খারাপ হয় বা কষ্ট পায় তাহলে সে নিউরো টেকনোলজি দিয়ে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। বিশ্বজুড়ে প্রায় দেড়লাখ মানুষের ক্ষেত্রে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে পারকিনসন্স থেকে শুরু করে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসওর্ডার (ওসিডি)ও রয়েছে। গবেষকরা বলছেন যে, এমন কমপ্লেক্স ডিসঅর্ডারসহ ডায়াবেটিস বা স্থুলতা নিয়ন্ত্রণেও নিউরো টেকনোলজি বেশ সম্ভাবনাময় এবং তারা মনে করছেন যে, কোনো ব্যাথার ফলে যদি স্মৃতি লোপ পায় তবে সেটাও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে, একশ বছর পরের সেই নিউরসায়েন্সের যুগে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হবে মানুষের মস্তিস্ক। তখন অস্ত্র, গোলা-বারুদ, নিউক্লিয়ার বোমা বা পেশী শক্তির যুদ্ধ হবে না। তখন যুদ্ধ হবে মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে। শব্দ তরঙ্গ দিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষকে হামলা করবে। যার সবচেয়ে বেশী মেধা আর আইডিয়া থাকবে সেই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল সায়েন্সের নাফিল্ড বিভাগের গবেষক লরি পাইক্রফট বলছেন,

আগামী দশ বছরের মধ্যে যদি বাণিজ্যিকভাবে স্মৃতি পুন:স্থাপনের মতো বিষয় ঘটে তবে আমি মোটেও অবাক হব না।”

তার হিসেবে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তি হয়তো এমন সুবিধা এনে দেবে যাতে করে মস্তিষ্কের সেই সব সংকেত ধারন করা যাবে যা স্মৃতি বা মেমোরি তৈরি করে। মি. পাইক্রফট মনে করছেন যে, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চলে আসবে। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণে সামান্য একটা ভুল অনেক বড় একটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।

আর এদিকে নিউরোসায়েন্স যতই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা ততটাই আতঙ্কের কথা জানান দিচ্ছে। সবকিছুরই বিপরীত ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে! এপর্যন্ত নিউরোসায়েন্সের সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে ‘ব্রেইনজ্যাকিং’ ।

ব্রেইনজ্যাকিং হচ্ছে ‘ব্রেইন হাইজ্যাক বা ব্রেইন হ্যাকিং’। হ্যাকাররা চাইলে আপনার মস্তিষ্কের সিগন্যালের এক্সেস ভেঙ্গে আপনার মস্তিষ্ক হাইজ্যাক করতে পারে। আপনার মনের গোপন তথ্য, চিন্তা, ব্যাঙ্কের পিন, সোশ্যাল মিডিয়া পাসওয়ার্ড সব জেনে ফেলতে পারবে এবং হ্যাকার চাইলে ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে অর্থ দাবি করে বসতে পারে। আর যদি তা না পায় তবে সব স্মৃতি মুছে ফেলা বা নতুন করে স্মৃতি তৈরির হুমকিও দিতে পারে। এমনকি তারা চাইলে তাদের মত করে আপনার ব্রেইন কন্ট্রোলিংও করতে পারবে।
ব্রেইনজ্যাকিংয়ের ভয়াবহতা এক্সপেরিমেন্ট করতে, ২০১২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক – হেডসেট ব্যবহার করা হয় এমন একটি জনপ্রিয় গেমিং থেকে মানুষের ব্রেনওয়েভ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাংক কার্ডের পিন নম্বরের মতো তথ্য বের করে ফেলেছিলেন। বর্তমানে ক্যাস্পারস্কি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ব্রেইনজ্যাকিংয়ের নিরাপত্তার জন্য যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

ক্রেডিট : Muntasirmahdi.info

Arjun Deba Nath


ফেসবুকে : Arjun Deba nath

Pages